রকিব কামাল
মহান দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় হবে শহর থেকে দূরে নির্জন কোন জায়গায়, যেখানে থাকবে না কোলাহল, পরিবেশ হবে মুক্ত, শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে অপরুপ প্রাকৃতিক কোলে আর প্রকৃতি হবে তাদের শিক্ষক।” সেই আদলে যেন যাত্রা শুরু দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়ের।
যান্ত্রিকতার পাশ কেটে, নাগিরক কোলাহলমুক্ত পাহাড়ের কোল ঘেষে, পাখির কলতান ভরা বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ পূর্ণ করতে চলেছে পথ চলার ৪৯ বছর। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জ্ঞানরাজ্যের আলোদিশারী হয়ে অবতীর্ণ দেশের উচ্চ শিক্ষার কর্ণদার রুপে।
শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞানের পাশাপাশি ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেখেছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ঘড়ির কাঁটার মতো অবিরাম ছুটেচলা, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি, পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যদিয়ে দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ আজ পূর্ণ করতে যাচ্ছে ঐতিহ্যের ৪৯ বছর। অনেকটা ক্ষুদ্র পরিসরে এবারের আয়োজন হতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের। সম্মেলন কক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
১৯৬৪ সালের ২৯ আগষ্ট পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার পর ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন।
বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাস ও অর্থনীতি-এ চার বিভাগ থেকে ৭জন শিক্ষক ও ২০২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি আজ ৮টি ইনস্টিটিউট ও ৪৩টি বিভাগ, ৫টি গবেষণা কেন্দ্র, ৮৫৯ জন শিক্ষক, ৩০৪ জন কর্মকর্তা এবং প্রায় ২৩ হাজার ৩২৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের আবাসনের জন্য রয়েছে ১১ টি হল। এর মধ্যে সাতটি ছাত্র ও চারটি ছাত্রীদের।
শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে একমাত্র বাহন ‘শাটল’, যা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এ শাটলের হুইসেলে প্রাণ ফিরে পায় সবুজ ক্যাম্পাস। দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর রয়েছে এখানে। পাঠ্যপুস্তক সহায়ক এবং দেশি-বিদেশি দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ বই, সাময়িকী, পত্র-পত্রিকা, জার্নাল ও পান্ডুলিপিসহ তিন লক্ষাধিক বইয়ের সংগ্রহশালা এ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীটি।
তাছাড়া শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে মেডিকেল সেন্টার। খেলাধূলার জন্য উত্তর প্রান্তে রয়েছে আধুনিক জিমনেশিয়াম ও কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ। ক্যাম্পাসের আদ্যেপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর নজরকাড়া সব স্থাপত্য শিল্প। মহান স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধাদের স্মরণে কলা ভবনের সামনে নির্মান করা হয়েছে “স্বাধীনতা স্মারক” ভাস্কর্য। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে নির্মান করা হয় বুদ্ধিজীবী চত্বর।
ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্রে নির্মান করা হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। মুক্তিযুদ্ধে আত্নদানকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর সন্তানদের সম্মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে নির্মান করা হয় “স্মরণ”।
অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত ধারা সূচিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলে এবং অনুষদে তারবিহীন ইন্টারনেট ‘ওয়াইফাই’ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা, যে কোন অরাজক পরিস্থিতি এড়ানোর লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ১০ টি স্পটে বসানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড.মোহাম্মদ ইউনুস, সাহিত্য বিশারদ আবুল ফজল, আলাউদ্দীর আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, স্থাপত্য শিল্পী মর্তুজা বশির, ড.আনিসুজ্জামান, উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.জামাল নজরুল ইসলাম, ড. অনুপম সেন, ঢালী আল মামুন, বর্তমান বিচারপ্রতি এস.কে সিনহা সহ দেশবরেণ্য বহু কীর্তিমান মনীষীর পদচারণায় সুপ্রতিষ্ঠিত আজকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে এক খন্ড রাঙ্গামাটির ন্যায় ঝুলন্ত সেতু, প্রাকৃতিক ঝর্ণা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, কাটা পাহাড়, পাখি এবং হরিণসহ বিভিন্ন জীববৈচিত্রের অপরুপ সমাহার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সব মিলিয়ে পুরো সবুজ ক্যাম্পাস কে মনে হবে শিল্পির রং তুলিতে আঁকা স্বপ্নীল ছবি।
প্রতিক্ষণ/এডি/এফটি